ভূত আছে কি নেই। এই নিয়ে আলোচনা সমালোচনারও শেষ নেই। এক শ্রেনীর মানুষ আছে , যারা ভূত বিশ্বাসী। আর এক শ্রেনীর মানুষ আছেন, যারা প্রমান ছাড়া কোন কিছুকেই বিশ্বাস করতে নারাজ এবং স্বভাবতই ভূত অবিশ্বাসী। আবার এমন এক শ্রেনীর মানুষ আছেন, যারা জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস করেন না, সাধু-সন্তদের অলৌকিক ক্ষমতায় আস্থাশীল নন, কিন্তু ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। কারন এরা নিজের চোখে ভূতে পাওয়া মানুষের অদ্ভুত কান্ড কারখানা দেখেছেন।
ভূত নাকি রোগ?
এই ভূতে পাওয়া মানুষ নিয়েই আমার মূল আলোচনা। যেহেতু, সাধারনভাবে আমরা বিভিন্ন মানসিক রোগ এবং মস্তিষ্ক স্নায়ু কোষের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না, তাই মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বিশৃঙ্খলার জন্য ঘটা অদ্ভুত সব ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা নিজেদের কাছে হাজির করতে পারিনা। কিছু কিছু মানসিক রোগীদের ব্যাপার স্যাপার দেখে তাই আমাদের চোখে যুক্তিহীন ঠেকে। আমরা ভেবে বসি আমি যেহেতু এর ব্যাখ্যা পাচ্ছি না, তাই বুদ্ধি দিয়ে এর ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিটি ভূতে পাওয়ার ঘটনারই ব্যাখ্যা আছে। বুদ্ধিতেই এর ব্যাখ্যা মেলে। বাস্তবিক পক্ষে ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য যা প্রয়োজন, তা হল আগ্রহ। ব্যাখ্যা খুজে পাওয়ার আগ্রহ।
আমরা প্রায় সময় ভূতে পাওয়া মানুষের গল্প শুনি। এমনকি অনেকে নিজের চোখে ভূতে পাওয়া মানুষকে দেখেছেন। কিছু উদহারন দিলে বিষয়টা আরো সহজ হবে। অনেক সময় শোনা যায় কোন তরুনী মেয়েকে ভূতে পেয়েছে। সে তার বাড়ির পেয়ার বা তেতুল গাছের নিছে যাওয়ার সময় তাকে ভুতে পায়। তার পর থেকেই ঐ তরুনী অস্বাভাবিক আচরন করতে শুরু করে , এমনকি গলার স্বরও পাল্টিয়ে পুরুষের মত হয়ে যায়। তখন সে এমন সব আচরন করে যা কখনও সেই তরুনী করতো না। এমনকি অনেক সময় ভূতে পাওয়া সেই তরুনী তাকে কোন ভূতে পেয়েছে সেটাও বলে। এবং প্রায় সময় ওঝা এসে এসব ভূত তাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও আরো অনেক ধরনের ভূতে পাওয়া মানুষ দেখা যায়। যেমন- কিছু ভূতে পাওয়া মানুষ কাল্পনিক মানুষকে দেখে, তার সাথে কথা বলে, যা আমরা দেখি না কিন্তু সে দেখে। আবার কিছু ভূতে পাওয়া মানুষ আছে, যারা কোন কিছুর স্পর্শ টের পার। যার কারনে সে অস্থির আচরন করে।
আসলে পৃথিবীতে ভূত বলতে কিছু নেই। তাহলে প্রশ্ন আসে- ঐসব মানুষগুলো হঠাত্ করে ঐ রকম ভূতুরে কার্যক্রম করে কেন ? ঐসব ভূতে পাওয়া মানুষগুলো আসলে মানসিক রোগি। একটু যুক্তি সংগতভাবে চিন্তা করলে বিষয়টা আমরা সহজেই বুজতে পারবো। মানসিক চিকিত্সায় ভূতে পাওয়া বলে পরিচিত মনের রোগকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
- হিষ্টিরিয়া।
- স্কিটসোফ্রেনিয়া।
- ম্যানিয়াক
- ডিপ্রেসিড।
সাধারনভাবে সংস্কারে আছন্ন, অশিক্ষিত, অল্প-শিক্ষিত বা যুক্তিবাদের আলো থেকে দূরে থাকা মানুষদের মধ্যেই হিষ্টিরিয়া রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সাধারন ভাবে এইসব মানুষের মস্তিষ্ককোষের স্থিতিস্থাপকতা ও সহনশীলতা কম। যুক্তি দিয়ে গ্রহন করার চেয়ে বহুজনের বিশ্বাসকে অন্ধভাবে মেনে নিতে অভ্যস্ত। মস্তিষ্ক কোষে সহনশীলতা যাদের কম, তারা এক নাগাড়ে একই কথা শুনলে, ভাবলে, বা বললে মস্তিষ্কের কিছু কিছু কোষ বার বার উত্তেজিত হতে থাকে, আলোড়িত হতে থাকে। ফলে মস্তিষ্কের কার্যকলাপে বিশৃঙ্খলা ঘটে। মনে করুন, এমনই এক মানুষ সন্ধ্যার পরে বাইরে গেল। তারপর তার মনে চিন্তা এলো, সামনের পেয়ারা গাছটায় তো ভূত আছে, নিশ্চয়ই ভূতটা আমাকে ধরেছে। তখন এই চিন্তাটা বার বার তার মস্তিষ্কে ঘোরপাক খায় এবং অবচেতন মন তা তীব্রভাবে বিশ্বাস করে। ফলে তার অবচেতন মন ভূতটির যেরকম কাহিনী শুনেছিল সেই রকম আচরন শুরু করে। প্রশ্ন উঠতে পারে- তাহলে, ওঝা কিভাবে তাকে ভালো করে ? ঐ একই কথা। তার অবচেতন মনে এটাও থাকে যে ওঝা আসলে ভূত চলে যাবে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওঝা সফল হয়। আসলে এখানে অতিপ্রাকৃত কিছু নেই এটা একটা রোগ মাত্র !
গতিময়তা মস্তিষ্ককোষের একটি বিশেষ ধর্ম। স্কিটসোফ্রেনিয়ারোগের শিকার হন গতিশীল মস্তিষ্কের অধিকারীরা। তারা কোনও কিছু গভীরভাবে চিন্তা করতে গিয়ে সঠিকভাবে চিন্তার মূলে পৌছাতে না পারলে, অথবা কোন রহস্যময়তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে অতি আবেগপ্রবনতার দরুন রহস্যময়তার হাত থেকে নিজেকে বের করে আনতে না পাড়লে, তাদের মস্তিষ্কের গতিময়তা কমে যায়। মস্তিষ্কের চালককেন্দ্র এবং সংবেদন কেন্দ্র ধীরে ধীরে শ্লথ হতে থাকে, অনড় হতে থাকে। এর ফলে এরা প্রথমে বাইরের জগত্ থেকে তারপর একসময় নিজের সত্তা থেকে নিজেকে আলাদা করে নেয়। মস্তিষ্ককোষের এই বিশৃঙ্খলার কারনে রোগীর ব্যবহারে বাস্তববিমুখতা দেখতে পাওয়া যায়। রোগীরা এই অবস্থায় অলীক বিশ্বাসের শিকার হয়। পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে ভিত্তি করে অলীক বিশ্বাসও পাঁচ রকম হতে পারে:-
- দর্শনাভূতির অলীক বিশ্বাস।
- শ্রবনাভূতির অলীক বিশ্বাস।
- স্পর্শানুভূতির অলীক বিশ্বাস।
- ঘ্রানানুভূতির অলীক বিশ্বাস।
- জিহ্বানুভূতির অলীক বিশ্বাস।
এইসব বিষয়ে আমরা জানি না বলে, এই সব রোগীকে আমাদের কাছে অদ্ভুত মনে হয়। আর ভূতের মুখরোচক গল্পের কারনে আমরা এটাকে ভুতের সাথে মিশিয়ে ফেলি। আসলে পৃথিবীতে ভূত বলতে কিছু নেই। যুক্তির বাইরে কিছুই থাকতে পারে না। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে সঠিক যুক্তিটা আমরা জানি না, কিন্তু সত্যিকারের জানার আগ্রহ থাকলে জানার সময়ও বেশি লাগে না।
লেখক বলছি- " এই বিষয়ে কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।"
একটি মন্তব্য করতে প্রবেশ বা নিবন্ধন করতে হবে।